বয়লার ডি-স্কেলিং সমন্ধে বিস্তারিত আলোচনা
বয়লার সিস্টেমের কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ অপরিহার্য। এর মধ্যে ডি-স্কেলিং (De-scaling) প্রক্রিয়া অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। বয়লার দীর্ঘদিন ব্যবহারের পরে পানিতে থাকা খনিজ পদার্থ, যেমন ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সালফেট এবং সিলিকা, বয়লারের হিটিং সারফেসে জমা হয়। এই জমাট বাঁধা পদার্থকে সাধারণত “স্কেল (Scale)” বলা হয়।
স্কেল জমা হলে বয়লারের কার্যকারিতা কমে যায়, ফুয়েল খরচ বেড়ে যায় এবং যন্ত্রাংশে অতিরিক্ত চাপ পড়তে পারে। এর ফলে বয়লারের জীবনকাল হ্রাস পায় এবং নিরাপত্তা ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। ডি-স্কেলিং হলো সেই প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে স্কেল অপসারণ করা হয় এবং বয়লারের হিট ট্রান্সফার ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করা হয়।
এই আর্টিকেলে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব —
-
বয়লার স্কেল: কারণ ও প্রভাব
-
ডি-স্কেলিং পদ্ধতি ও ধরণ
-
প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণ ও টেকনিক্যাল কনসিডারেশন
-
শিল্পে বাস্তব প্রয়োগ
-
চ্যালেঞ্জ ও উদ্ভাবনী সমাধান
-
রিকমেন্ডেশন ও সেরা চর্চা
১. বয়লার স্কেল: কারণ ও প্রভাব
১.১ স্কেল কেন হয়?
বয়লারের পানি প্রাকৃতিকভাবে বিভিন্ন খনিজ পদার্থ ধারণ করে। যখন পানি উত্তপ্ত হয়ে বাষ্পে রূপান্তরিত হয়, তখন দ্রবীভূত খনিজ পদার্থ পানিতে থেকে যায় এবং হিটিং সারফেসে জমা হয়। এই স্কেল প্রধানত ক্যালসিয়াম কার্বোনেট, ম্যাগনেসিয়াম কার্বোনেট, সিলিকা এবং সালফেট নিয়ে গঠিত।
স্কেল জমার প্রক্রিয়ার মূল কারণগুলো হলো:
-
উচ্চ TDS (Total Dissolved Solids) মান
-
ভারী ফিড ওয়াটার এবং অপর্যাপ্ত ট্রিটমেন্ট
-
বয়লারের দীর্ঘমেয়াদী অপারেশন
-
অপারেটরের মনিটরিং ও রক্ষণাবেক্ষণ ঘাটতি
১.২ স্কেলের প্রভাব
স্কেল বয়লারের কার্যকারিতাকে সরাসরি প্রভাবিত করে। এর প্রভাবগুলো হলো:
-
হিট ট্রান্সফার হ্রাস: স্কেল হিটিং সারফেসের উপর জমে তাপ পরিবহণ কমায়। ফলে ফুয়েল খরচ বেড়ে যায়।
-
ফুয়েল এফিসিয়েন্সি হ্রাস: একই পরিমাণ বাষ্প উৎপাদনের জন্য বেশি ফুয়েল ব্যবহার করতে হয়।
-
কোরোসন ও ক্ষয় বৃদ্ধি: স্কেল জমার কারণে লোহা ও ইস্পাতের ধাতু দ্রুত ক্ষয় হয়।
-
ব্লোডাউন প্রভাবিত হয়: স্কেল জমে বটম ব্লোডডাউন কার্যকারিতা কমে যায়।
উদাহরণস্বরূপ:
| ফিড পানি TDS (ppm) | স্কেল জমার সময় (মাস) | সম্ভাব্য ফুয়েল সাশ (%) | প্রভাব |
|---|---|---|---|
| 200 | 12 | 2 | হালকা স্কেল, কম প্রভাব |
| 400 | 6 | 4 | মাঝারি স্কেল, ফুয়েল বাড়ে |
| 600 | 3 | 6 | ভারী স্কেল, হিটিং সারফেস ক্ষয় |
২. ডি-স্কেলিং পদ্ধতি ও ধরণ
২.১ কেমিক্যাল ডি-স্কেলিং
কেমিক্যাল ডি-স্কেলিং হলো সবচেয়ে প্রচলিত এবং কার্যকর পদ্ধতি। এতে ব্যবহার হয় অ্যাসিড বা অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ, যা স্কেল দ্রবীভূত করে পানি দ্বারা ধুয়ে বের করা হয়।
কেমিক্যাল ডি-স্কেলিংয়ের ধাপ:
-
বয়লার শাটডাউন ও কুলিং
-
ডি-স্কেলিং কেমিক্যাল (যেমন: HCl, sulfamic acid) মিশ্রণ করা
-
সঠিক ডোজ ও সময় অনুযায়ী প্রক্রিয়া চলা
-
স্কেল দ্রবীভূত হওয়ার পর পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলা
-
নিরপদে পুনরায় বয়লার অপারেশন শুরু করা
২.২ মেকানিক্যাল বা ম্যানুয়াল স্কেল অপসারণ
কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষ করে ভারী বা ক্রিস্টালাইন স্কেল, মেকানিক্যাল পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এতে স্কেলকে হাত বা যন্ত্রপাতি দিয়ে খসে ফেলা হয়। এই পদ্ধতি সাধারণত কেমিক্যাল ট্রিটমেন্টের পরে করা হয়।
২.৩ হাইব্রিড পদ্ধতি
কিছু শিল্পে কেমিক্যাল ও মেকানিক্যাল উভয় পদ্ধতি একসাথে ব্যবহার করা হয়। প্রথমে কেমিক্যাল দ্রবীভূত করে স্কেল নরম করা হয়, তারপর মেকানিক্যালভাবে অবশিষ্ট স্কেল অপসারণ করা হয়।
প্রতিটি পদ্ধতির তুলনামূলক সুবিধা:
| পদ্ধতি | সুবিধা | সীমাবদ্ধতা |
|---|---|---|
| কেমিক্যাল | দ্রুত, কার্যকর, নির্ভুল | কেমিক্যাল হ্যান্ডলিং ঝুঁকি, ডিস্ট্রিবিউশন প্রয়োজন |
| মেকানিক্যাল | কেমিক্যাল ছাড়াই সম্ভব, প্রাকৃতিক উপাদান | সময়সাপেক্ষ, শ্রমসাপেক্ষ, হিটিং সারফেস ক্ষয় হতে পারে |
| হাইব্রিড | দ্রুত ও নির্ভুল, নিরাপদ | বেশি খরচ, ট্রেনিং প্রয়োজন |
৩. প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণ
৩.১ স্কেল দ্রবীভূত করার কেমিক্যালের ধরন
-
HCl (হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড): শক্তিশালী, দ্রুত স্কেল অপসারণে কার্যকর
-
Sulfamic acid: নিরাপদ এবং কন্ট্রোলড ডি-স্কেলিং
-
Phosphoric acid বা Polyphosphate: ফসফেট স্কেল কমাতে ব্যবহৃত
৩.২ ডি-স্কেলিং সময়সূচি
বয়লারের অপারেশন, ফিড পানি গুণমান এবং স্কেল জমার হার অনুযায়ী ডি-স্কেলিং করতে হয়। সাধারণভাবে,
-
লোড ও কম TDS বয়লার: ১২‑১৮ মাস অন্তর
-
মিড লোড, মাঝারি TDS: ৬‑১২ মাস অন্তর
-
হাই লোড, উচ্চ TDS: ৩‑৬ মাস অন্তর
৩.৩ নিরাপত্তা ও মনিটরিং
ডি-স্কেলিং প্রক্রিয়ায় রসায়নিক ব্যবহারের কারণে PPE (Personal Protective Equipment) ব্যবহার বাধ্যতামূলক। কেমিক্যাল ইনজেকশন, ডোজিং এবং PH/Conductivity নিয়মিত মনিটর করা আবশ্যক।
৪. শিল্পে বাস্তব প্রয়োগ
৪.১ বাংলাদেশি শিল্পে প্রয়োগ
বাংলাদেশের টেক্সটাইল, কাগজ, সুগার মিল ইত্যাদিতে ডি-স্কেলিং নিয়মিত না হলে স্কেল জমে বয়লার ক্ষয় ও ফুয়েল খরচ বেড়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, একটি মেল্টিং বয়লার যেখানে প্রতি বছর ডি-স্কেলিং করা হয় না, তার হিট ট্রান্সফার ক্ষমতা ১৫‑২০% কমে যেতে পারে।
৪.২ খরচ ও সঞ্চয়
সঠিক সময়ে ডি-স্কেলিং করলে ফুয়েল সাশ, রক্ষণাবেক্ষণ খরচ কমানো সম্ভব। এছাড়া স্কেল অপসারণের ফলে বয়লারের জীবনকাল বৃদ্ধি পায়।
৪.৩ পরিবেশ ও সাসটেইনেবিলিটি
কেমিক্যাল ডি-স্কেলিংয়ের পর ব্যবহার হওয়া ওয়াটার সঠিকভাবে ট্রিট করলে পরিবেশবান্ধবভাবে নিষ্কাশন করা সম্ভব।
৫. চ্যালেঞ্জ ও উদ্ভাবনী সমাধান
৫.১ চ্যালেঞ্জ
-
ভারী স্কেল অপসারণে সময় ও খরচ বেশি
-
কেমিক্যাল হ্যান্ডলিং ঝুঁকি
-
অপ্রত্যাশিত বয়লার স্টপেজ
-
অপর্যাপ্ত ট্রেনিং ও SOP
৫.২ উদ্ভাবনী সমাধান
-
অটোমেটিক কেমিক্যাল ইনজেকশন সিস্টেম
-
রিয়েল-টাইম PH ও Conductivity মনিটরিং
-
স্মার্ট স্কেল ডিটেকশন সেন্সর
-
হাইব্রিড ডি-স্কেলিং পদ্ধতি, যেখানে কেমিক্যাল ও মেকানিক্যাল একসাথে ব্যবহৃত হয়
৬. রিকমেন্ডেশন
| ধাপ | বিবরণ |
|---|---|
| সময়মতো ডি-স্কেলিং | বয়লারের ফিড পানি মান, লোড ও স্কেল ট্রেন্ড অনুযায়ী |
| নিরাপত্তা | PPE ব্যবহার, কেমিক্যাল হ্যান্ডলিং নিয়মকানুন অনুসরণ |
| রেকর্ডিং | প্রতিটি ডি-স্কেলিং প্রক্রিয়ার ডোজ, সময়, ফলাফল রেকর্ড রাখা |
| ট্রেনিং | অপারেটর ও রক্ষণাবেক্ষণ টিমের জন্য SOP ও ট্রেনিং সেশন |
| পরিবেশ | ব্যবহার হওয়া কেমিক্যাল পানি পরিবেশবান্ধবভাবে নিষ্কাশন |
উপসংহার
বয়লারের ডি-স্কেলিং শুধুমাত্র রক্ষণাবেক্ষণ কাজ নয়; এটি বয়লারের কার্যকারিতা, নিরাপত্তা, ফুয়েল সাশ এবং দীর্ঘমেয়াদী স্থায়িত্বের জন্য অপরিহার্য। সঠিক সময়সূচি, ট্রিটমেন্ট পদ্ধতি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করলে বয়লারের জীবনকাল বৃদ্ধি পায়, অপারেশনাল কার্যকারিতা উন্নত হয় এবং রক্ষণাবেক্ষণ খরচ কমে।
“Effective de-scaling is not just maintenance; it is the pathway to sustainable and efficient boiler operations.”
Tag:Course


